ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচের রিপোর্ট: সবুজ দেখতে পার্থে লায়ন-স্পিনে ধরাশায়ী ভারত (১৮ই ডিসেম্বর ২০১৮)


২০১৮-এর প্রথম থেকে শুরু হয়েছে, একই গল্প চলছে। কেপটাউনে লক্ষ্য ছিল ২০৮, তারপর সেঞ্চুরিয়ানে লক্ষ্য ছিল ২৮৭, এজবাস্টনে লক্ষ্য ছিল ১৯৪, সাউথাম্পটনে ২৪৫, ওভালে ৪৬৪ এবং আজ পারথে লক্ষ্য ছিল আবার ২৮৭। সবকটায় ফলাফল একই - মুখ থুবড়ে হার। এডিলেডেও চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করতে নেমে ম্যাচ হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া, কিন্তু সেই হারের মধ্যেও অনেকখানি লড়াই ছিল। কমজোরী ব্যাটিং লাইন-আপের উপরিভাগ আউট হয়ে গেলেও ক্যাঙ্গারুর লেজের মতো শক্তিশালী অস্ট্রেলীয় টেল লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ২৮৭ রান তাড়া করতে নেমে ভারত তো ১৪০ রানেই গুটিয়ে গেল! ১৪৬ রানের এই হারকে আদৌও কি কোহলিরা লজ্জার হার হিসেবে মানছেন? ম্যাচ শেষের পর সাংবাদিক সম্মেলনে অধিনায়কের কথা শুনে তা কিন্তু মনে হয়নি!

এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে- টস যেত, ম্যাচ যেত! ইংল্যান্ডে সবকটা টসেই বিরাট হেরেছিলেন, সিরিজ হেরেছিলেন। সেই সিরিজে তিনি ১-২টো টস জিতলে কি হতো তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন হলো এডিলেডে তিনি টসে হারলে ভারত আদৌ কি ১-০ এগোতে পারতো? এবার পারথে ফিরে আসা যাক। ম্যাচ শুরুর আগেই পারথের পিচ নিয়ে যে কথার ঝড় তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া মিডিয়া, পিচ কিউরেটর এবং প্রাক্তন খেলোয়াড়েরা তা পুরোটাই যে ভারতীয় দলকে বোকা বানানোর জন্য তা বলাই বাহুল্য। পেন জানতেন পিচে কোনো অসুবিধা নেই, তাই পেন পারথে টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন অস্ট্রেলিয়া ভুল করছে! কিন্তু তাঁরাই ঠিক ছিলেন! আর বছরের গোড়া থেকেই দেখা যাচ্ছে ভারত বিদেশে গিয়ে মাঠের লড়াইতে তো হারছেই, কিন্তু তার আগে মাঠের বাইরের লড়াইতেও হেরে বসে থাকছে! প্রায় ৪০টা টেস্টে অধিনায়কত্ব করার পরেও বিরাট এখনোও পিচ দেখে চিনতে পারেন না, সঠিক দল নির্বাচন করতে পারেন না! আর এই বিষয়ে যাঁদের বিরাটকে সাহায্য করার কথা সেই কোচ এবং সাপোর্ট স্টাফেরা কি করেন, তা আমার মতো ক্রিকেটপ্রেমীদের ধারণার বাইরে! অস্ট্রেলিয়া নিজের ১১জনের দল আগের দিন ঘোষণা করে দিয়েছিলো এবং তাতে নাথান লায়নের নামটিও জ্বলজ্বল করছিলো এবং দিনের শেষে এই লায়ন পারথের অদ্ভুত পিচে গোটা ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা! সবুজ পিচ দেখে অত্যুসাহী ভারতীয় দল ৪ জন পেসার খেলায়। কিন্তু তাতেও ভুবনেশ্বর কুমার থাকেন না! ভুবি হয়তো মনে মনে ভাবছেন যে, আমি নিজের বলের পেস বাড়ালাম, ব্যাটিংয়ে ধার বাড়ালাম- তারপরেও আর কি করলে টেস্ট দলে অন্তত "সেকেন্ড চয়েস " হতে পারি?

টসে হেরে বোলিং করতে নেমেই ভারতীয় বোলাররা শর্ট অফ গুড লেংথ বা শর্ট বল করতে লাগলেন ( যদিও একটিও কাঁধের উচ্চতা বা তার বেশি উচ্চতায় বাউন্সার ছিল না)! প্রথম সেশনেই পরিষ্কার হয়ে যায় পুরোনো পারথ আর নতুন পারথের পিচে আকাশ-পাতাল পার্থক্য! অন্যান্য পিচের তুলনায় গতি অল্পবিস্তর বেশি হলেও বাউন্স পুরোনো পারথের ধরে কাছেও নয়! আর এই স্টেডিয়াম পুরোপুরি ঘেরা হওয়ায় কোনো হাওয়াও আসেনা, যা পেসারদের সাহায্য করতে পারবে। সুনীল গাভাস্কারের ভাষায় - "রাজকোটের পিচ, দেখতে সবুজ, আদতে পাটা"! তা সত্ত্বেও সবুজ পিচে অল্প হলেও পেসারদের জন্য সুবিধে ছিল, কিন্তু ভারত তা ব্যবহার করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়! স্ট্রেটিজির ভুলে প্রথম দিনের প্রথম সেশন ভারতীয় বোলাররা অস্ট্রেলিয়াকে দান করেন! প্রথম উইকেটে অস্ট্রেলিয়া তুললো ১১২ এবং ওখানেই ভারত ম্যাচে অনেকখানি পিছিয়ে পরে, যা পরে আর "মেক আপ" করতে পারেনি! অদ্ভুত আরো একটি ঘটনা হলো, প্রথম দিনে ভারতীয় বোলাররা, বুমরাহ বাদ দিয়ে বাকি সকলে অনেক কম জোরে বল করলেন! ইশান্ত শর্মার পেস তো ১৩০-এর উপর উঠছিলো না! তিনি যে "নো-বল"-এর ভয়ে সাবধানী হয়ে বল করছিলেন, সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো! বাকিদের কি গরমের জন্য সমস্যা ছিল নাকি অন্যকিছু,তা জানা যায়নি! ফলে ভারতীয় বোলারদের বলে সেই এডিলেডের কামড়টা ঠিক ছিলো না। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া তুললো ৩২৬। আবারোও ভারত ২৫১-৬ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে ৩২৬ অবধি তুলতে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ স্কোর করেন নতুন ওপেনার হ্যারিস - ৭০।ভারতের হয়ে ইশান্ত নিলেন ৪ উইকেট এবং অনিয়মিত স্পিনার বিহারি ২ উইকেট নিয়ে গেলেন!

এরপর প্রথম ইনিংসে ভারত ব্যাট করতে নেমেই ১০-২! হর্ষ ভোগলে এই সময়ে টুইট করে পুরোনো কথা মনে করলেন। একসময়ে বিদেশের মাটিতে ১০-২ স্কোর ছিল ভারতের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা! আর এরপরে ব্যাট করতে নামতেন লিটল মাস্টার সচিন টেন্ডুলকার। একা তিনি কাঁধে করে বাহুবলীর মতো দলকে তুলে নিয়ে যেতেন। বিপক্ষ জানতো, সচিনের উইকেটটা পাওয়া মানেই ভারত শেষ! কিন্তু তারপরে সচিনকে সাহায্য করতে এসেছিলেন কোনো এক সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষণ, বীরেন্দ্র শেহবাগ - গড়ে উঠেছিল স্বপ্নের "টিম ইন্ডিয়া"। কিন্তু এখন যেন সেই বিশবছরের আগের ইতিহাস ফিরে এসেছে মডার্ন মাস্টার - বিরাট কোহলির হাত ধরে। ভারতের প্রথম ইনিংসের ২৮৩ রানের মধ্যে বিরাটের একার রানই ১২৩, আর এই ১২৩ রানের যে ইনিংসটি তিনি খেললেন পারথে সেটি তাঁর জীবনের সেরা ইনিংসগুলির সেরা পাঁচে নিশ্চয়ই থাকবে! রাহানে (প্রথম ইনিংসে ৫১) দ্বিতীয় দিনের শেষে কাউন্টার এটাক করে যেভাবে শুরু করেছিলেন, তৃতীয় দিনের শুরুতেই লায়নকে উইকেট দিয়ে এসে আরও একবার নিরাশ করলেন। লায়ন আরোও একবার ৫ উইকেট নিয়ে গেলেন, এই সবুজ পিচেও! কাকতালীয়ভাবে ভারতেরও ৬ নম্বর উইকেটের পতন হয় ২৫১ রানেই, কিন্তু সেখান থেকে ভারত ২৮৩ রানের বেশি তুলতে পারেনি তার কারণ ভারতের টেলের ব্যাটিং-এর অপটুতা! ঋষভ পান্থ যেভাবে পরের পর ম্যাচে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসছেন তাতে বলাই যায় সপ্তম উইকেট থেকেই ভারতের ব্যাটিংয়ের লেজ বেরিয়ে পরে! ৪-৫ বছর আগেও এই ৭ নম্বরে ব্যাট করতে আসতেন ধোনি,তারপর কুম্বলে নয়তো হরভজন, এমনকি ১০ নম্বরে নেমে জাহির খান,আর পি সিংহরাও বিদেশে গিয়ে রান করে এসেছেন!



৪৩ রানে এগিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া তোলে ২৪৩। যে পিচে ২০০ রান তাড়া করাকেই কঠিন হিসেবে ধরা হচ্ছিলো সেখানে অস্ট্রেলিয়া ভারতের সামনে লক্ষ্য রাখে ২৮৭ রানের। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ওপেনারের আরো একবার ভালো শুরু করেন। এরোন ফিঞ্চ আঙুলে আঘাত পেয়ে অবসৃত হলেও আরেক ওপেনার হ্যারিস, খোয়াজাকে সঙ্গে নিয়ে অসমান বাউন্সের পিচে আঘাত পেয়েও লড়াই চালিয়ে যান। প্রথম উইকেট পরে ৫৯ রানে। খোয়াজা লড়াই চালিয়ে যান চতুর্থ দিন লাঞ্চের পর অবধি! পন্টিংয়ের কালো ঘোড়া খোয়াজা ৭২ রান করে যান!
চতুর্থ দিনের সকালে প্রথম সেশনে কোনো উইকেট তুলতে না পেরে ভারতীয় বোলাররা আবার একবার ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের হতাশ করেন। এরপর লাঞ্চের পরে ভারতের মহম্মদ শামি একটি আগুনে স্পেল করেন এবং ৪ উইকেট তোলেন ওই স্পেলে (ইনিংসে ৬ উইকেট)। ৪টির মধ্যে তিনটি উইকেট আসে বাউন্সারে! এই স্পেলে শামি হয়তো লিলি-থমসনের ভয় ধরানো পারথের শহরে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের বাউন্সারে নাকানি চোবানি খাইয়ে কোথাও না কোথাও একটা বদলা তো নিয়ে গেলেন!  শামির ওই স্পেলটা নির্দ্বিধায় ভারতীয় ফাস্ট বোলিং ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় স্পেলগুলির মধ্যে প্রথম তিনে জায়গা করে নেবে। ২০১০-এ সাউথ আফ্রিকায় শ্রীসন্থ জ্যাক কালিসকে যে বাউন্সারে আউট করেছিলেন কিংবা সেরকম কিছু আউট ভারতীয় বোলাররা আগে করে থাকলেও শামির এদিনের মতো ভয় ধরানো টানা ৬-৭ ওভারের স্পেল আমি অন্তত আগে দেখিনি!


ভারতীয় ফাস্ট বোলাররা যেদিন ভারতের মাথা গর্বে তুলে দিয়েছিলেন, ঠিক সেদিনই ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা লজ্জার সমুদ্রে ডুবিয়ে দিলেন! ২৮৭ রান তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারের চতুর্থ বলেই রাহুল প্লেইড অন হলেন। আমার প্রশ্ন এরপরেও কি রাহুলকে টানা হবে?
বিজয় পুরোনো রূপের সামান্য ঝলকানি দেখালেও লায়নের বলে পরাস্ত হলেন। বিরাটও পারলেন না। লায়ন দ্বিতীয় ইনিংসেও ৩টি উইকেট নিয়ে গেলেন। বিজয়, বিরাট আর পান্থ। রাহানে সামান্য লড়াই করার চেষ্টা দেখালেও শেষমেশ উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে এলেন। উইকেটে পরে থাকার মানসিকতা কোথায়? শেষ এরকম মানসিকতা দেখেছিলাম হয়তো সদ্য প্রাক্তন হওয়া গৌতম গম্ভীরের কাছে, নেপিয়ারে। নবাগত বিহারীকেই বোধহয় সবচেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান লাগছিলো এদের মধ্যে (কিন্তু তিনি কি আর পরের ম্যাচে সুযোগ পাবেন?)। চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করা ক্রমাগত বিভীষিকা হয়ে উঠছে ভারতের সামনে! এরপরে প্রশ্ন উঠছে তাহলে টস হারা মানেই কি ম্যাচ হারা? আর একটি লক্ষণীয় বিষয়, সিরিজের প্রথমে স্লেজিং-বিতর্ক নিয়ে সতর্ক থাকার অনেক অঙ্গীকার করেছিলেন দুই অধিনায়কই। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে এসে মনে হচ্ছে, ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মতো হাই-ভোল্টেজ সিরিজে তা সম্ভব নয়! স্লেজিং কে শুরু করেছিলেন তা জানা নেই, কিন্তু এই টেস্টে শেষ হাসি তো টিম পেনই হাসলেন। সিরিজের প্রথম ম্যাচ জিতেও দুর্বল প্রতিপক্ষকে মাথায় উঠার সুযোগ করে দেওয়া, চতুর্থ ইনিংসে বারবার এই হেন অবাক করা আত্মসমর্পণ, বারংবার পিচ চিনতে ভুল করা, ম্যাচ সিচুয়েশন বুঝতে না পারা, বারবার দল নির্বাচনে গলদ - এইতো ২০১৮-এর বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দলের নিদর্শন! সেই দলের কোচ আবার বলেন, "বেস্ট ট্যুরিং টীম...নো প্লেস ইজ এওয়ে ফর আস...", একটা ম্যাচ জিতলেই, "হেল উইথ প্রাকটিস.."!



এরপর আরও দুটি টেস্ট আছে ভারতের কাছে। এখনও সিরিজ জেতার সুযোগও আছে, আর আমি মনে করি সেই ক্ষমতাও আছে এই বিরাটের দলের। যদিও পৃথ্বিকে এই সিরিজে আর পাচ্ছে না ভারতীয় দল। মায়াঙ্ক আগারওয়ালকে তলব করা হয়েছে, সঙ্গে হার্দিক পাণ্ড্যকেও (১৮ জনের দলেও চলছে না, ১৯ নম্বর সদস্য হিসেবে হার্দিক যাচ্ছেন!)। শুভমান গিল আর অভিমন্যু ঈস্বরণকেও পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল না? করুন নায়ারই বা কি দোষ করেছিলেন? ওদিকে রোহিত শর্মার স্ত্রী আবার সন্তানসম্ভবা, তাই শর্মাজী দেশে ফিরে আসছেন বলে খবর, তাই তাঁকেও মেলবোর্নে পাবেনা ভারত। শিখর ধাওয়ানও রঞ্জি না খেলে ওদেশেই বসে আছেন বলে খবর! আজকাল ভালো স্পিনারদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের যে দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে, রঞ্জি বা ঘরোয়া টুর্নামেন্ট না খেলা -এটাও একটা কারণ। সচিন কি রঞ্জি খেলতেন না? সৌরভ তো দল থেকে বাদ পড়ার পর শিলিগুড়ির মতো ছোট শহরে গিয়েও ম্যাচ খেলেছেন! ও হ্যাঁ, আজ তো আবার আইপিএল অকশন! রঞ্জি খেলে কে কবে বড়োলোক হয়েছে?


                                                                               ~ সৌরিত্র ব্যানার্জী

     (বল পড়ে ব্যাট নড়ে ব্লগ থেকে পুনঃপ্রকাশিত )

Comments