ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও দুর্ধর্ষ বোলিংয়ের জন্য বাকি টিমগুলির চেয়ে এগিয়ে ভারত


ক্রিকেটে একটা চলতি কথা আছে- ব্যাটসম্যান তোমায় ম্যাচ জেতাতে পারে কিন্তু টুর্নামেন্ট জেতাবে তোমায় বোলার। রবি শাস্ত্রী-বিরাট কোহলির ভারত এখন এই তত্ত্বেই বিশ্বাসী। একটা সময় ছিল ভারতে ব্যাটসম্যানের কোনো অভাব ছিল না, কিন্তু ভালো বোলার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। স্পিন বোলারের খুব একটা অভাব না থাকলেও প্রকৃত ফাস্ট বোলার ছিল ডুমুরের ফুল। সৌরভ গাঙ্গুলীর সময় থেকে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন আসলেও বিরাট কোহলি ঠিক এই জায়গাটিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বিরাটের পূর্বসূরি ধোনিও স্পিনেই বেশি বিশ্বাস রাখতেন, কিন্তু বিরাট বিশ্বাস করেন আগুনে পেস এটাক-এ। তিনি এই ভারতীয় দলে যেমন ফিটনেসের বিপ্লব ঘটিয়েছেন,তেমনই ফাস্ট বোলিং-এও। বুমরাহ-সামি-ভুবেনেস্বর-হার্দিক এখন যে কোনো পরিবেশে যেকোনো প্রতিপক্ষের কাছে ত্রাস। ভুলে যাবেন না উমেশ, নভদীপ সাইনি, খলিল, ইশান্ত শর্মা - যারা যেকোনো ভালো টিমে প্রথম এগারোতে খেলতে পারেন, ভারত বিশ্বকাপে তাদের নেট-বোলার হিসেবে ব্যবহার করছে! মানে ভাবুন ফাস্ট বোলারদের পুলটা কতটা মজবুত ভাবে তৈরী হয়েছে। এর পেছনে যেমন বিরাট কোহলি-রবি শাস্ত্রীর মাথা রয়েছে, ঠিক তেমনই রয়েছে বোলিং কোচ ভরত অরুণের পরিশ্রম। এর সঙ্গে যোগ করুন কুলদীপ-চাহালের রিস্ট স্পিন। জাদেজা টিমে থাকলেও প্রথম এগারোতে সুযোগ পাবার আশা নেই। তার ওপর অশ্বিন তো বছর দুই হলো শুধুই টেস্ট ম্যাচে সুযোগ পান। কিন্তু এই অশ্বিন-জাদেজা অন্য যেকোনো দলের প্রথম এগারোয় হেসে খেলে ঢুকবেন!

প্রসঙ্গত ১৯৮৩ বিশ্বকাপ, ২০১১ বিশ্বকাপ, ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সবকটিতেই ভারতীয় বোলাররা টুর্নামেন্ট জিতিয়েছিলেন।


  • ১৯৮৩ বিশ্বকাপের স্ট্যাট লিংক: https://en.wikipedia.org/wiki/1983_Cricket_World_Cup_statistics
  • ২০১১ বিশ্বকাপের স্ট্যাট লিংক: https://web.archive.org/web/20110808035154/http://stats.espncricinfo.com/icc_cricket_worldcup2011/engine/records/bowling/most_wickets_career.html?id=4857%3Btype%3Dtournament
  • ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্ট্যাট লিংক: http://stats.espncricinfo.com/twenty20wc/engine/records/bowling/most_wickets_career.html?id=3115;type=tournament
  • ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি স্ট্যাট লিংক: http://stats.espncricinfo.com/icc-champions-trophy-2013/engine/records/bowling/most_wickets_career.html?id=7371;type=tournament  


এবারে আসি চলতি বিশ্বকাপের কথায়। চলতি বিশ্বকাপের স্ট্যাট লিস্টে প্রথম পাঁচে কোনো ভারতীয় বোলার নেই। তার প্রথম কারণ অবশ্যই ভারত ম্যাচ কম খেলেছে এবং তার মধ্যে একটি ম্যাচে বৃষ্টির জন্য একটি বলও খেলা হয়নি (এবারে বিশ্বকাপের অদ্ভুত ক্রীড়াসূচির জন্যে ভারতের প্রথম ৫টি ম্যাচ খেলতে ১৮দিন লাগলেও শেষ ৪টি ম্যাচ ১০দিনের
মধ্যে!)। কিন্তু গ্রুপ লীগের ৯টি ম্যাচের শেষেও উইকেট পাওয়ার তালিকায় প্রথম ৫-এ কোনো ভারতীয় না থাকলেও অবাক হবেন না, কিন্তু প্রথম ১০-এ একাধিক ভারতীয় বোলারের নাম দেখতে নিশ্চই পাবেন। তার কারণ ভারতের বোলাররা দলগতভাবে পারফর্ম করছে। অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক কিংবা পাকিস্তানের আমির একাই প্রতি ম্যাচে ৪-৫টি করে উইকেট তুলতে পারেন, কারণ তাদের দলে উইকেট নেবার লোকের অভাব। এদিকে ভারতের প্রধান বোলার সকলেই ফর্মে এবং সকলেই একত্রে উইকেট তুলছেন। তাই ৫ ম্যাচ পরেও এখনও কারও ইনিংসে ৫-উইকেট নেই! ভারতীয় বোলারদের উইকেট সংখ্যার দিকে একবার চোখ রাখা যাক।

  • যজুবেন্দ্র চাহাল - ৫ ম্যাচে ১০টি উইকেট (Avg - ২৪.১০, Economy- ৫.৪৭)
  • জসপ্রীত বুমরাহ - ৫ ম্যাচে ৯টি উইকেট(Avg - ২১.৭৭, Economy- ৪.৪৫)
  • মহাম্মদ সামি - ২ ম্যাচে ৮ উইকেট  (Avg - ৭.০০, Economy- ৩.৪৬)
  • ভুবনেশ্বর কুমার- ৩ ম্যাচে ৫টি উইকেট (Avg - ২০.৪০, Economy- ৪.৫০)
  • হার্দিক পাণ্ড্য - ৫ ম্যাচে ৫টি উইকেট (Avg - ৪৪.৪০, Economy- ৫.৬৯)
  • কুলদীপ যাদব- ৫ ম্যাচে ৪টি উইকেট (Avg - ৫১.৭৫, Economy- ৪.৪০)
  • বিজয় শঙ্কর - ৩ ম্যাচে ২টি উইকেট (Avg - ১১.০০, Economy- ৪.১২)

কুলদীপকে বাদ দিলে সকলেই দারুন ছন্দে রয়েছেন। কুলদীপ খুব বেশি উইকেট না পেলেও আসতে আসতে ছন্দে ফিরছেন, রান গলতে দিচ্ছেন না। আর তাঁর হাত থেকে বেরোনো যে ডেলিভারিতে বাবর আজম (পাকিস্তান ম্যাচে)- সেটি এখনো পর্যন্ত নিঃসন্দেহে এই টুর্নামেন্টের সেরা বল। এছাড়া সকল ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞর মতে, বিশ্বকাপ যত এগোবে, ইংল্যান্ডের শুকনো পিচে স্পিনারদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ হবে। আর সেখানে ভারতের ঝুলিতে জাদেজা সমেত যে দুই রিস্ট স্পিনার আছে, তা কোনো দলের নেই। শুধু তাই নয়, সবমিলিয়ে স্পিনার এবং ফাস্ট বোলার মিলিয়ে (পঞ্চম বোলার হিসেবে হার্দিকও দারুন বল করছেন) ভারতীয় বোলিংকে নির্দ্বিধায় টুর্নামেন্টের সেরা বোলিং এটাক বলা চলে।


এবার আসা যাক ব্যাটিংয়ের কথায়। টুর্নামেন্টের শুরুতেই শিখর ধাওয়ানের ছিটকে যাওয়া অবশ্যই ভারতের কাছে খুব বড়ো ধাক্কা। এরপরে যোগ করুন চার নম্বর স্লটের দুশ্চিন্তা। চার নম্বরে প্রথম দুই ম্যাচে রাহুল খুব খারাপ করেননি।
ঠিক সকলে যখন রাহুলকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধছিলেন, ধাওয়ান ছিটকে যাওয়ায় তাঁকে ওপেনিং-এর দায়িত্ব নিতে হলো এবং এখনও পর্যন্ত তিনি সেই সুযোগ মোটেও ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। ধাওয়ান ঠিক যতটা আক্রমণাত্মকভাবে শুরু করে রোহিতের ওপর চাপ কমাতেন, রাহুল ঠিক ততটাই রক্ষণাত্মকভাবে শুরু করছেন। প্রথম পাওয়ার প্লে-তে ভারতের স্কোর বেশি থাকছে না এবং সেই চ্যাপ্টা গিয়ে পড়ছে মিডল অর্ডারের ওপর। বিরাট কোহলি সেই চাপ সামলাতে পারলেও বাকিরা পারছেন কি? বিজয় শঙ্কর মোটেও ভরসা দিচ্ছেন না। আর এরপর ধোনি এসে ডট বল খেলছেন খুব বেশি। বিশেষ করে স্পিনের বিরুদ্ধে আটকে যাচ্ছেন। বিরাট এবং রোহিত যদি ভারতের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভরসা হন, তবে ব্যাটিং-এ  এই মুহূর্তে ভারতের তিন নম্বর ভরসার নাম হার্দিক
পাণ্ড্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর আফগানিস্তান ম্যাচ বেরিয়ে গেলেও তাই ব্যাটিং নিয়ে বিরাটের চিন্তা কাটছে না। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ এই মুহূর্তে পান্থকে সুযোগ দেবার পক্ষপাতী। বোলার শঙ্কর যখন দলের খুব বেশি দরকারে লাগছে না তখন পান্থ নয় কেন? কিংবা ফিনিশার কার্তিক? পান্থ আসলে দলে একজন বাঁহাতি আসবে এটা একটা সুবিধে, সেদিক থেকে কার্তিক আবার ফিল্ডিংয়ে এগিয়ে। সেক্ষত্রে ধোনি হয়তো চারে খেলবেন।

ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর করতে পারলে সেমিফাইনাল বা ফাইনালেও ভারতকে রোখার মতো দল কই? ভারত ছাড়া আর একটি দলকে ঝকঝকে দেখাচ্ছে- সেটা হলো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। ভারতের কাছে হারের পর তারা যেন নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর ঠিক একই ভাবে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যাদের সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন ধরা হচ্ছিলো সেই ইংল্যান্ড এখন সেমিফাইনালে যেতে পারবে কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত। ইংল্যান্ড যদি শেষ পর্যন্ত না যেতে পারে তবে
চতুর্থ স্থান দখল করার পরের দাবিদার অবশ্যই এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের নতুনরূপে মেলে ধরা বাংলাদেশ। শাকিবের কাঁধে চেপে সেমিফাইনালের স্বপ্ন তারা দেখছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য তাদের শেষ ২টি ম্যাচে ভারত ও পাকিস্তানকে হারাতে হবে। পাকিস্তান অবশ্য ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের সাথে এবারের বিশ্বকাপের অদ্ভুত কাকতলীয় মিল খুঁজে পেয়েছে। সেমিফাইনালে তারা যদি সত্যিই উঠতে পারে, নক-আউটে পাকিস্তান বরাবর বিপজ্জনক। অন্যদিকে শ্রীলংকা ২টো ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেস্তে যাবার পরেও ম্যাথেউস -মালিঙ্গার কাঁধে চেপে সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনেক আশা দেখিয়ে প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে হারালেও বাকিটা শুধুই হতাশা। ঠিক তেমনই হতাশা আমলা-তাহির-ডুপ্লেসি-রাবাদা সমৃদ্ধ সাউথ আফ্রিকার। ডিভিলিয়ার্স এবং ডেল স্টেইন না থাকায় তাদের মনোবলটাই তলানিতে চলে যায়! আফগানিস্তানকে অবশ্য অনেককিছু শেখার বাকি আছে। ৫০-ওভারের টেম্পেরামেন্ট তৈরী করে সঠিক খেলোয়াড় চয়ন করা এখনোও তাদের শেখা বাকি।


সবমিলিয়ে বিশ্বকাপ প্রথমদিকে বৃষ্টিকাপ হয়ে উঠলেও অনেকগুলি ভালো ক্রিকেট ম্যাচ আমাদের উপহার দিয়েছে। শেষ পর্যায়ে বিশ্বকাপ এখন বিজনেস-এন্ডে আরোও কিছু চমক অপেক্ষা করে আছে নাকি সেটাই দেখার। আশা করবো আরো কিছু জমাটি ম্যাচ, জমে যাওয়া সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল। আমার প্রেডিকশন - ফাইনাল হবে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া।


                                                                                                           
                                                                                                            - সৌরিত্র ব্যানার্জী (২৮শে জুন ২০১৯)


Comments