ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফর : প্রিভিউ (২০শে নভেম্বর ২০১৮)
আগামীকাল, এই মাসের ২১ তারিখ থেকে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সূত্রপাত হতে চলেছে। প্রায় দু-মাসের অস্ট্রেলিয়া সফরে ভারত প্রথমে ৩টি টি-টোয়েন্টি, তারপর ৪টি টেস্ট, এবং শেষে ৩টি ওডিআই খেলবে। আগামীকাল ভারত-অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপাক্ষিক সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ব্রিসবেনে।
পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। ১৮৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ভারতে বাণিজ্য করতে আসা একদল ব্যক্তি কলকাতা এক্সিবিশনের সময় "ক্র্যাক অস্ট্রেলিয়ান টুয়েলভ" নামক একটি ক্রিকেট দল হিসেবে কলকাতাতে "প্রেসিডেন্সি ক্লাব টুয়েল্ভ" দলের বিরুদ্ধে প্রথম ক্রিকেট খেলতে নামে। সেই থেকেই ভারত অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সূত্রপাত। প্রেসিডেন্সি দলের অধিনায়ক ছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী (যাকে ভারতীয় ফুটবলের জনক বলা হয়)। নগেন্দ্রপ্রসাদ এবং মতিলাল সেন (যিনি মোহনবাগান দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন প্রথম) তারা দুজন হাত ঘুরিয়ে বল করতেন। এই দুই খেলোয়াড় ছাড়াও প্রখ্যাত সুরকার রাইচাঁদ বড়ালের পিতা, লালচাঁদ বড়াল-ও প্রেসিডেন্সি দলের হয়ে খেলেছিলেন। এর প্রায় ৬০ বছর পর পাটিয়ালার মহারাজের উদ্যোগে জ্যাক রাইডারের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া দল ভারতে খেলতে আসে, কিন্তু সেই ম্যাচ টেস্ট ম্যাচের স্বীকৃতি পায়নি; বেসরকারকারী টেস্ট ম্যাচ হিসাবেই খেলা হয়।
এর ঠিক ১২ বছর বাদে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় লালা অমরনাথের নেতৃত্বে (সেই দলে বিজয় মার্চেন্ট ছিলেন না - যা নিয়ে পরবর্তীকালে ডন ব্রাডম্যান আক্ষেপ করেছিলেন), সেই দলে ফজল মামুদ এবং আব্দুল হাফিজ কারদারকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে পাকিস্তান থেকে ভারতে ট্রেনে আসার অজস্র সমস্যার কারণে তারা যোগ দিতে পারেননি ভারতীয় দলে (পরবর্তীকালে তারা পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট ম্যাচ খেলেন, এদের মধ্যে আব্দুল হাফিজ কারদার ভারতের হয়েও টেস্ট খেলেছিলেন)। ১৯৪৭ সালের সেই সফর অনেক দিক থেকে ঐতিহাসিক। স্বাধীনতার পরে সেইবার ভারতীয় দলের হয়ে প্রথম শতরান করেছিলেন ভিনু মানকার, এই ম্যাচেই প্রথম ভারতীয় হিসেবে একটি টেস্ট ম্যাচের দুই ইনিংসেই শতরান করার কৃতিত্ব অর্জন করেন বিজয় হাজারে। এই সফরেই টেস্ট বাদে অন্য একটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ডন ব্র্যাডম্যানকে স্ট্যাম্প করেছিলেন প্রবীর সেন (ব্রাডম্যান নিজের ক্যারিয়ারে প্রথম শ্রেণীর খেলায় ওই একবারই স্ট্যাম্প আউট হয়েছিলেন)। এই সেই সফর যেখানে ভিনু মানকারের জন্য "মানকারেড" বলে একটি আউটের উদ্ভাবন হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রাউনকে তিনি ওই আউটটি করেছিলেন (আগে একটি ম্যাচে সাবধান করার পরেও পরের আর একটি ম্যাচে)।
তারপর ঠিক বিগত ৭০ বছরে অনেকবার ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপাক্ষীক সিরিজ হয়েছে, বিশ্বের অনেক বড়ো নামি দামি ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব যেখানে তাদের দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সেরকম বেশ কিছু খেলোয়াড়দের মধ্যে সুবিখ্যাত ছিলেন স্যার ডন ব্রাডম্যান, বিজয় হাজারে, কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কার, রিচি বেনো, চ্যাপেল ব্রাদার্স, মার্ক টেলর, সচিন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং, জাস্টিন ল্যাঙ্গার , ওয় ব্রাদার্স, সৌরভ গাঙ্গুলী, ভিভিএস লক্ষ্মণ, রাহুল দ্রাবিড়, গ্লেন ম্যাকগ্রা, শেন ওয়ার্ন, ডেনিস লিলি, অ্যালেন বর্ডার , গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, অনিল কুম্বলে, বীরেন্দ্র শেওয়াগ, এবং আরও অনেকে।
অস্ট্রেলিয়া সফর বললেই মনে পড়ে কিছু বিখ্যাত ক্রিকেটয় রোমান্সের গল্প, যেমন ১৯৮১-এর সফর, ১৯৯১-৯২ সফর ,১৯৯৯ সফর। সৌরভের আমল থেকে আবার অস্ট্রেলিয়া সফর মানেই ডেভিড আর গোলিয়াথের লড়াই। মনে পড়ে ২০০৪ কিংবা ২০০৮-এর বিতর্কিত সিরিজ গুলির কথা! কিন্তু কোনোদিনই ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট সিরিজগুলোতে সম্মান নিয়ে ফেরা হয়নি, সিরিজ জেতা তো দূর অস্ত! শেষবার অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট সিরিজে ভারতের দুর্দশার শেষ ছিল না! মহেন্দ্র সিং ধোনি সিরিজের মাঝপথে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করার পর বিরাটের ভারত অবশ্য কিছুটা লড়াই করার মানসিকতা দেখায়, কিন্তু সেটা পুরোপুরি ভাবেই বিরাট-কেন্দ্রিক ছিল। এই সেই সফর যখন অধিনায়কত্বের ব্যাটন হাতে পাবার পরেই নতুন এক বিরাট কোহলির উত্থান ঘটে, এবং তিনি নিজেকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। একদিনের ম্যাচগুলোতে ভারতের পারফরমেন্স সৌরভের আমল থেকেই ভালো ছিল. ধোনি অধিনায়ক হবার পর অস্ট্রেলিয়াতে ভারত প্রথম ওয়ান-ডে সিরিজ জেতে। শেষবারের সফরেও ভারত ওয়ান-ডে তে ভালো ফল করে, আর টি-টোয়েন্টি সিরিজে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম বিদেশী দল হিসেবে চুনকালি মাখিয়ে দেয় (পড়ুন হোয়াইট-ওয়াশ)।
আগামীকাল ব্রিসবেনে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে আরও একবার ভারত ফেভারিট হিসেবে নামছে। আজকের এই অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে একটা প্রযোজ্য, "সেই লঙ্কাও নেই, সেই রাবণও নেই!" এমনকি ডেভিড-গোলিয়াথের সেই ডেভিড (টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট ওয়ার্নার এবং অবশ্যই স্টিভ স্মিথ )-ও নেই। তাসত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে কথা বলবে না। স্টার্ক, হ্যাজেলউড বা কামিন্স না থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণ মোটেই ফেলে দেবার মতো নয়। টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট বোলার অ্যান্ড্রু টাই, বেহেরেনডর্ফ, কুলটার-নাইল, স্ট্যানলেক - আইপিএল-এর সুবাদে অনেকেরই পরিচিত নাম। যদিও অজি ব্যাটিং ভারতের তুলনায় যথেষ্ট নড়বড়ে। এরোন ফিঞ্চ, ম্যাক্সওয়েল, ডার্সি শর্ট, ক্রিস লীন নিজেদের দিনে একার হাতে ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা রাখেন, কিন্তু প্রত্যেকের-ই সমস্যা হলো, কবে যে তাদের নিজেদের দিন আসবে, আর কবে আসবে না, তার নিশ্চয়তা দেবার ক্ষমতা নেই! সেদিক থেকে ভারতের ব্যাটিং আর বোলিং দুটোই খাতায়-কলমে বেশি গোছানো। বরাবরের মতোই ভারতের প্রথম তিন ব্যাটসম্যান, অর্থাৎ ওপেনার রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ান আর ওয়ান ডাউন বিরাট কোহলির কাঁধেই গুরুদায়িত্ব। ধোনি না থাকায় কিপিং গ্লাভস সামলাবেন তরুণ ঋষভ পান্থ। হার্দিক না থাকলেও তার ভাই ক্রুনাল সম্ভবত খেলবেন। আর বোলিং সামলাবেন ভুবি-বুমরাহ জুটি, সাথে কুলদীপ আর খুব সম্ভবত নবাগত বাঁ-হাতি পেসার খলিল। কিন্তু মুশকিল হলো ষষ্ঠ বোলার দরকার হলে হাত ঘোরাবার কেউ নেই! আর ব্রিসবেনে নেমেই কানের পাস দিয়ে সাঁ-সাঁ করে বল গিয়ে যদি চটজলদি ৩টে উইকেট পড়ে যায়, তবে কে হাল ধরবে তাও জানা নেই!
চলতি বছরে ভারতের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে জেতার হার - ৮১.২০%, কিন্তু একসময়কার চ্যাম্পিয়ন দল অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে সেই হার - ৫৬.২৫%। গিলক্রিস্ট থেকে ওয়ার্ন, গাভাস্কার থেকে জাহির খান সকলেই এই সিরিজে একবাক্যে ভারতের ওপর বাজি ধরেছেন। এখন দেখা যাক মাঠের লড়াইতে কে জেতে !
এই সিরিজের সমস্ত আকর্ষণীয় খবর, ট্রিভিয়া, রিভিউ, প্রিভিউ জানার জন্য লক্ষ্য রাখুন আমাদের ব্লগ, ফেসবুক পেজ এবং টুইটার আক্যাউন্টে। .
- সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
ও
সৌরিত্র ব্যানার্জী
(বল পড়ে ব্যাট নড়ে ব্লগ থেকে পুনঃপ্রকাশিত )
Comments
Post a Comment